শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৫ ১৪৩১   ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

 ফরিদপুর প্রতিদিন
সর্বশেষ:
পর্যটন শিল্পের বিকাশে কুয়াকাটায় বিমানবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিতে পরিকল্পিত শিল্পায়ন করতে হবে ফের আশা জাগাচ্ছে লালদিয়া চর কনটেইনার টার্মিনাল দায়িত্বশীল ও টেকসই সমুদ্র ব্যবস্থাপনার আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক সফটওয়্যারের আওতায় সব সরকারি চাকরিজীবী
৯১০

ধন্যবাদ শিক্ষামন্ত্রী

প্রকাশিত: ৯ ডিসেম্বর ২০১৮  

সুমাইয়া হোসেন লিয়া: ধন্যবাদ মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ স্যার। শিক্ষার্থীদের অসন্তুষ্ট শিক্ষাব্যবস্থা, সকল ধরনের শিক্ষা বিষয়ক অনিয়ম-দুর্নীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাদের পক্ষে ন্যায় বিচারের এত সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

আমি এই ভিকারুননিসা নূন স্কুলের দশম শ্রেণির একজন ছাত্রী। আর কিছুদিন পরই এই স্কুল পাস করে কলেজে উঠে যাবো। তাই স্কুলের সাথে আমার আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের সময়সীমা আর বেশিদিন নেই। হিসাবে হাতেগোনা গোটা দুয়েক মাস কিংবা তার চেয়ে সামান্য বেশি। এই বিদ্যালয় সম্পর্কে আপনাদের ধারণা এই বিগত কয়েকদিনে কোথায় গড়িয়েছে জানি না। কিন্তু এতটুক বলতে পারি, এখনো এই বিদ্যালয়টি দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠগুলোর একটি।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ- এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি মেয়ের কাছে দ্বিতীয় আশ্রয় এবং স্বর্গের সমতুল্য। ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি! একদমই না। এমন কোনো শিক্ষার্থী পাবেন না যে এই বিদ্যালয়ে পড়ে কিন্তু স্কুল ছুটি হওয়া সত্ত্বেও এই স্কু্লপ্রাঙ্গণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেনি। নাহ, বিশেষ কোনো কারণে না। কারণে-অকারণে, আড্ডা দিতে, গ্রুপ স্টাডি করতে কিংবা আসন্ন যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের রিহার্সেল উপলক্ষে এই স্কুলের ক্যাম্পাস সবসময়ই আকাশী-সাদা ইউনিফর্ম পরা মেয়েদের পদচারণায় মুখরিত থাকে।

শুক্র-শনিবার, এমনকি গ্রীষ্ম বা শীতকালীন অবকাশের সময়ও বিনা ইউনিফর্মে- ফরমাল ড্রেসে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা লেগেই থাকে। কি নেই এখানে! প্লেগ্রাউন্ড, বিশাল বড় দুটো মাঠ; যা গাছ-গাছালিতে বেষ্টিত, আলো-বাতাসপূর্ণ ক্লাসরুম, ল্যাব, স্পোর্টসরুম, নানান ক্লাব, দুটো লাইব্রেরি, ভালো কিছু স্টাফ, হাজারখানেক মেধাবী ও সকল বিষয়ে পারদর্শী শিক্ষার্থী এবং সেরা কিছু শিক্ষক। একটু অবাক হলেন কি? অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। এই বিদ্যালয়ে যখন আমরা ঢুকি, তখন আমাদের শিক্ষিকাদের ম্যাডাম বলতে নিষেধ করা হয়, বলা হয় যেন আপা বলে সম্বোধন করি। কারণ হলো আমরা যেন তাদের শিক্ষক হিসেবে অতিরিক্ত ভয় পেয়ে দূরে সরে নাই যাই এবং একদম আপনজন হিসেবে কাছে পাই। মা-বাবার পরে শিক্ষকের স্থান, আমরা সবাই এটি মানি।

পত্রিকা খুললেই ভিকারুননিসার মেয়েদের কীর্তি আপনাদের চোখে পড়েছে। একবার নয়-দুইবার নয় হাজারবার। অস্বীকার করতে পারবেন না। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা, বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমে এই স্কুলের মেয়েরা ছেলেদের চেয়েও এগিয়ে। মেয়েদের জন্য এই বিদ্যালয়ের মত ভালো আর দ্বিতীয় কোনো বিদ্যালয় এই দেশে নেই। অসাধারণ শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য International Star for Quality Convention (ISAQ) আওয়ার্ডও পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। এই সকল কীর্তির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে শিক্ষকদের ভালবাসা, আদর, স্নেহ এবং শাসন।

এখন আসি এত ভালো একটি বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক কিভাবে ‘আত্মহত্যা’র মত ভয়াবহ ব্যাপারে একজন শিক্ষার্থীকে প্ররোচনা দিলেন।

আপনি যখন খারাপ থাকবেন, মানুষ আপনাকে ভালো হওয়ার পথ দেখাবে। খারাপ থেকে ভালো হওয়া সহজ। কিন্তু একবার ভালো হয়ে গেলে, সেটা বজায় রাখা খুবই কঠিন। (এই কথাটিও আমি একজন শিক্ষকের কাছ থেকেই শিখেছি)। আমাদের বিদ্যালয়ের অবস্থা এখন হয়েছে ঠিক একই রকম।

এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গৌরবের ভাগে যেন একটি আঁচড়ও না লাগে সেটি নিশ্চিত করতে গিয়ে হয়েছে হিতে বিপরীত। আরো ভেঙ্গে বললে, একজন শিক্ষার্থীর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সময়টিতে সে বেড়ে উঠে, নিজেকে আপন ছাঁচে গড়ে তোলে এবং মানুষ হিসেবে নিজেকে উপলব্ধি করে। সেই সময়টির বেশিরভাগ অংশ তার স্কুলেই কাটে। অর্থাৎ ৭ বছর বয়স থেকে বড়জোর ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের একটি বিরাট অংশ সে স্কুলে কাটায়। সেই স্কুলে সে যা শেখে, যেভাবে শেখে তা ই সে আয়ত্ত করে। অনেক সময় দেখা যায় শিশুটির ফলাফল আশানুরূপ না হলে শিশুটির শিক্ষকদের দোষারোপ করা হয়। আবার শিক্ষকগণ শিশুটিকে দোষারোপ করার পাশাপাশি পিতামাতাকেও দোষারোপ করেন। এই দোষারোপের বেড়াজালে শিশুটি নিজের সামর্থ্য, নিজের ভুল শুধরানোর মানসিকতা এবং একই সাথে ভালো করার প্রত্যয় হারিয়ে ফেলে। যার ফলে সৃষ্টি হয় ত্রিমুখী সংকট। এই সংকট শুধুমাত্র লেখাপড়ায় খারাপের জন্যই হয়ে থাকে না, বরং আরো নানা কারণে তৈরি হয়। পরীক্ষায় খারাপ করলে অনেক ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে বিধায় অরিত্রী মুঠোফোন নিয়ে গিয়েছিল।

একজন মানুষ তখনই অপরাধ করতে বাধ্য হয় যখন তার সামনে আর পথ খোলা থাকে না।

প্রতিযোগিতা অবশ্যই ভাল, কিন্তু এত বড় একটি বিদ্যালয়ে ১ নম্বর কম পাওয়ার জন্যে শ’খানেক শিক্ষার্থীর পিছনে পড়তে হয়। এই পিছনে পড়া, অন্যের সাথে নিজের তুলনা এবং নানা ধরনের কটুক্তির  মুখোমুখি হওয়া এ  ভয় থেকেই তৈরি হয় ‘যেকোনো মূল্যে ভাল ফলাফল’ করার স্পৃহা।

যখন একজন শিক্ষার্থী তার সামর্থ্যের বাইরে কিছু অর্জন করার চাপ প্রতিনিয়ত অনুভব করে, প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দেয়া হয় তার সহপাঠীরা সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও কি করে তার চেয়ে ভালো করে, সে কেন পারে না- এসব নানামুখী হিসাব যখন একজন শিশুর (১৮ বছরের নিচে সকলেই শিশু) মস্তিস্কে ঘুরপাক খায় তখন সে কীভাবে তার সামর্থ্যের বাইরের কিছু অর্জন করবে অসৎ উপায় অবলম্বন না করে?

যখন তারা তা অর্জন করতে পারে না তখন হেয় প্রতিপন্ন হয় নিজ বন্ধুমহল, আত্মীয় স্বজন, পিতামাতা এমনকি শিক্ষকদের কাছে থেকেও। যারই ফলাফল স্বরূপ প্রতিবছর বোর্ড পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর শিক্ষাক্ষেত্রে পাশের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি আত্মহত্যার হার বৃদ্ধিও লক্ষ্য করি।

শিক্ষার্থী, শিক্ষক কিংবা শুধু পিতামাতাই দায়ী এসবের জন্য? একদম নয়। এর পিছনে অন্যতম একটি কারণ হলো সহযোগিতার অভাব। এই শিক্ষাব্যবস্থার অনেক ক্ষতিকর দিক যেমন এর জন্য দায়ী, সেই সাথে দায়ী শিক্ষক-অভিভাবকের মধ্যবর্তী দূরত্ব।

ভিকারুননিসার মত নামী একটি স্কুলে নিয়মমাফিক প্যারেন্টস মিটিং হয় প্রতিবছর। তবুও কেন এই সংকট দেখা দিল যার পরিণতি এত ভয়াবহ? উত্তর হলো, নিয়মমাফিক হলেও সকল ক্ষেত্রেই শুধুমাত্র শিক্ষক এবং অভিভাবকের পরষ্পরের দোষারোপ, শিশুর কাংক্ষিত ফলাফলের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়া, স্কুলের নানান ভালো-খারাপ দিক উঠে আসে। কিন্তু কখনই উঠে আসে না কিভাবে একজন শিক্ষার্থীকে মানবিক করা যায়, মানসিকভাবে সচেতন করা যায়, আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলা যায় কিংবা পরবর্তীতে ‘ভালো’  মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য কি করণীয় তা শেখানো হয় না।

দোষ আসলে শুধু সেই ৩ জন শিক্ষকের না যাদের নাম প্রকাশ পেয়েছে, দোষ সেই অরিত্রীর কিংবা তার বাবা-মা কারো না। দোষ আমাদের সবার। কারণ, আমরা সবাই এই শিক্ষাপদ্ধতি মেনে নিয়েছি যেখানে আমরা ‘শিক্ষা’ বলতে কেবলই অর্থ উপার্জন করার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান কিংবা নিজের নাম সম্বলিত কিছু সার্টিফিকেট অর্জন করাই বুঝি।

শিক্ষা যে সামগ্রিক একটি ব্যাপার যার মধ্যে পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানের পাশাপাশি মানসিক সচেতনতা, মানবিকতার উন্মেষ, ন্যায়-অন্যায় পার্থক্যকরণ এবং একই সাথে নৈতিকতার প্রসার সৃষ্টির বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত তা আমরা ভুলে গেছি। যারই ফলাফল আজকের এই ঘটনা।

আমারই একজন শিক্ষক বলেছিলেন, ‘আমি যদি প্রতিদিন তোমাদের নৈতিকতা শেখানোর জন্য ৪০ মিনিটের ক্লাসের ১০ মিনিট খরচ করি, তখন তোমাদের অভিভাবকরাই বলবে আমি কিছু পড়াই না’। কথাটি সত্য। স্কুলে কিছু পড়ায় না- এই মর্মে অভিভাবকরাই কোচিং এর পিছনে সন্তানদের নিয়ে ছুটেন এবং কোচিং বাণিজ্যের প্রসার ঘটান।

ভিকারুননিসা নুন স্কুল, লেখাপড়ার ব্যাপারে এতটাই কঠোর এবং আন্তরিক যে আমরা এই স্কুলে পড়েই ভাল ফলাফল করি, কিন্তু পাশাপাশি বিভিন্ন কোচিং এ দৌড়াই বাবা-মা এর আত্মিক তৃপ্তি বৃদ্ধির জন্য।

‘অমুক’ স্কুলে পড়া একটি শিক্ষার্থী কখনো পিছিয়ে পড়তে পারে না- এই কথা প্রতিটি নামী-দামী শিক্ষার্থীর কানে গুঁজে দেয়া হয় স্কুলে প্রথম পা রাখার পর থেকেই। অন্যান্য এলাকাভিত্তিক বা সেরাদের তালিকায় নিচের দিকে থাকা বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের তুলনায়, ভিকারুননিসা, আইডিয়াল, রাজউকের শিক্ষার্থীদের মানসিক চাপের পরিধি কয়েকগুণ পরিমাণ বেড়ে যায় শুধুমাত্র সেই স্কুলের ট্যাগ তাদের গায়ে লেগে যায় বলে। কারণ, এই সকল স্কুলের শিক্ষার্থীদের ফলাফল বোর্ড পরীক্ষায় যেমন ‘গোল্ডেন’ এর নিচে আশা করা যায় না তেমন করে স্কুলের পরীক্ষাতেও সেরা ১০ এর তালিকার নিচে থাকা যায় না। এই সবার জন্য ‘সমান’ আশা করা কখনই পাপ নয়, বরং অতি ভালো।

কিন্তু বেশি ভালো করতে গিয়ে যখন আমরা শিক্ষাকে বোঝা হিসেবে একজন শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কে চাপিয়ে দেই, সেটি কতটুকু যৌক্তিক? আত্মহত্যা মানে হলো নিজেকে হত্যা। আজ অরিত্রীর খবরটি এত সারা ফেলেছে, তার পেছনে স্কুলের ট্যাগটিও কিন্তু অনেক বড় একটি কারণ। একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন, অরিত্রীর মৃত্যু সংবাদ যদি ফ্রন্টের হেডলাইনে আসে তাহলে পত্রিকার পাতা খুলে ভিতরের পাতাতে বিভিন্ন এলাকার ছাত্রছাত্রীদের একই কারণে মৃত্যুর সংবাদ ও দেখবেন। অনেক বার দেখেছেনও, কিন্তু গায়ে লাগাননি। তবুও শুধু আজ নয়, এমন কোনো মৃত্যু কোনোদিনই কাম্য নয়।

পাপকে ঘৃণা করো, পাপিকে নয়- এই বাক্যটিও আমাদের শিক্ষা থেকে অর্জিত অংশ। কিন্তু আমরাই এই অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগাতে পারছি কি? অরিত্রী নকল করেছিল কি করেনি তার আগে বড় বিষয় স্কুলে মুঠোফোন নিয়ে যাওয়া, যেটি অপরাধ। সে অপরাধ করেছে, শাস্তি স্বরূপ অভিভাবক ডাকা হয়েছিল। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা, কিন্তু অস্বাভাবিকতার শুরু তখন থেকেই যখন একজন শিক্ষার্থীর মনে ‘যে কোনো মূল্যে ভালো ফলাফল করা’র ভূত চেপে যায়। অরিত্রী এত ভালো ছাত্রী হয়েও কেন নকলের চেষ্টাতে আটকে গিয়েছিল? অবশ্যই তার মাথায় সেই বাড়তি চাপ ছিল যা তাকে নকল করতে বাধ্য করেছিল। এই স্কুলের কোনো ছাত্রী খারাপ করবে, এটি কেও বিশ্বাস করে না। আপনিও করবেন না। আমাদের শিক্ষকরাও চান আমরা ভাল করি। এই ভালটা সম্পূর্ণ আমাদের কিন্তু ব্যাপকতার দিক দিয়ে তা স্কুলের সম্মানও বয়ে আনে। এই ‘ভাল’ ফলাফল করানোর জন্য জোর-জবরদস্তি এখন নিত্যদিনের প্রতিটি ঘরের ঘটনা। একজন বাবা-মা যদি সন্তানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ না হন তাহলে সন্তান আপনাকে অকারণে অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ভয় পাবে। একই সাথে একজন শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীর ভয় কাটাতে সক্ষম না হয় তবে তার শিক্ষকতার ২০ শতাংশই অকেজো।

কাউকে অপমান করা যে অন্যায়, সেটি আমরা সকলেই জানি। উদ্দেশ্য সৎ থাকলেও কাজটি যদি অন্যায় হয় সেটি কখনই মেনে নেওয়ার মতো বিষয় নয়। একজন শিক্ষকের অধিকার আছে শিক্ষার্থীকে অপরাধের জন্য শাসন করার কিন্তু সেই অপরাধের বোঝা তার পিতা-মাতার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অধিকার তাদের নেই।

ওই যে বললাম, উদ্দেশ্য সৎ থাকলেও অন্যায়ভাবে কোনো কিছু করাটাও অন্যায়। শিক্ষকরা অবশ্যই ভুলটিকে তুলে ধরেছিলেন এবং শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু হয়তো সেটি এভাবে না হলেও পারতো। অরিত্রীর দোষ ত্রুটিকে উল্লেখ করে তাকে তার পিতামাতার কাছে তুলে দেয়াটাই ছিল কাম্য। কিন্তু সবচেয়ে বড় যে অংশটি আমরা এড়িয়ে যাই তা হলো কেন কোনো অপরাধ শনাক্ত হওয়ার পর সেই অপরাধের পিছনের কারণগুলো তুলে ধরে তা শুধরানোর সুযোগ সৃষ্টি হয় না? অরিত্রীকে তার পিতামাতাসহ অপমানের বদলে যদি সকলে মিলে অরিত্রীর ভীতিটির ভিত কোথায় কিংবা কেন সে এই অন্যায়টি করলো তা জিজ্ঞাসা করা হতো এবং সুন্দর করে বুঝিয়ে বলা হতো তবে কি সে আমাদের মাঝে থেকে আজ হারিয়ে যেত?

অরিত্রি কেন, কারোর এমন মৃত্যুই কাম্য নয়। ‘দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়না’ –প্রমথ চৌধুরীর এই বিখ্যাত উক্তিটি আমরা সবাই জানি।

শুধুমাত্র দেহের মৃত্যু ঘটামাত্রই কেন আমাদের টনক নড়ে? কিসের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটে চলা আত্মার মৃত্যুর খবর রাখি না? শিক্ষা কেন আমাদের জীবনের চেয়েও বড় হয়ে গেল যে তা অর্জন করতে গিয়ে আমাদের জীবনটিই দিয়ে দিতে হচ্ছে?

উত্তর নেই। থাকার কথাও না। কারণ শাসনের নামে প্রতিটি পিতামাতাই শিখেছেন ভয়ভীতি দেখাতে, প্রতিটি শিক্ষক শিখেছেন শাস্তি দিতে। তারা উভয়ই ভুলে যান দিনশেষে আমরা এতটাই একা হয়ে যাই যে, এত বড় পৃথিবীটাও আমাদের কাছে ছোট হয়ে আসে আর সেই গলায় ঝুলে পড়া ফাঁসটিই শেষ আশ্রয় হিসেবে ধরা দেয়।

মূল সমস্যা শুধু এই স্কুলেই নয়, পুরো দেশে বিরাজমান। এই স্কুলের একজন অরিত্রীর কথা প্রকাশ পেয়েছে, কত অরিত্রী কত জায়গায় একই কারণে প্রাণ দিচ্ছে তার হিসেব সকলেরই অজানা।

শিক্ষামন্ত্রী আমাদের এই ক্যাম্পাসের এসেছিলেন বছর খানেক আগে, পাঠ্যপুস্তক বিতরণ উৎসবে। তিনি আমাদের ছাত্রীদের জাতীয় সংগীত গাওয়া শুনে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি তখনও বলেছিলেন আমাদের বিদ্যালয়ের সকল অর্জনের কথা। আমি নিজেও সেদিন মাঠে উপস্থিত ছিলাম, হয়তো অরিত্রীও। আজ শিক্ষামন্ত্রীকে একই বিদ্যালয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত ও নেক্কারজনক একটি ঘটনার জন্য আসতে হয়েছিল বলে আমরা সকলেই ব্যথিত।

সকল শিক্ষকই আমাদের গুরুজন। যে তিনজন শিক্ষক এর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা প্রত্যেকেই অন্যান্য শিক্ষকদের মত আমাদের আগলে রেখেছিলেন। এটিও সত্যি প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকদের মতই কিছু শিক্ষক অবশ্যই বুঝে-না বুঝে মানসিক আঘাত এখানেও করেন, কিন্তু সেটি সম্পূর্ণ সেই সকল শিক্ষকদের ব্যক্তিগত আচরণবিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত, এটির জন্য সমগ্র শিক্ষকগোষ্ঠীকে দোষারোপ করা কখনই উচিত নয়। এই স্কুলের প্রতিটিই শিক্ষকই তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে এত বেশি সচেতন যে তারা অনেক সময় ভুলে যান আমাদের গ্রহণ ক্ষমতা কতটুকু।

আশা করি ভবিষ্যতে আর কোনো অরিত্রী এভাবে অকালে ঝরে পড়বে না। কখনো অরিত্রীর সহপাঠি, অনুজ, অগ্রজদের মত চোখের পানি আর কাওকে ফেলতে হবে না। সেইসাথে প্রতিটি পিতামাতা যেন নিজেদের সন্তানদের সকল কিছুর ঊর্ধ্বে বিবেচনা করেন এবং তাদের বোঝার চেষ্টা করেন সেই আশাবাদও ব্যক্ত করি।

শিক্ষকদের সাথেই যেহেতু দিনের বেশি সময় কাটে, তারাও যেন আমাদের নিজ সন্তানের মত দেখেন এবং কখনো পুরনো বা ফেলে আসা ভুল ত্রুটি নিয়ে আঘাত না দেন সেটিই কাম্য। এমন ঘটনা আর কোথাও যেন না ঘটে সেটিও এখন সকলের প্রার্থনা।

পরিশেষে বলতে চাই, প্রতিটি মানুষের জীবনের মূল্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে। অরিত্রীর জন্য আজ দেশবাসী ব্যথিত। সকলের আশা তার পিতামাতা ও কাছের মানুষদের এই শোকের সময় সৃষ্টিকর্তা ধৈর্য দিবেন। শিক্ষামন্ত্রী এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করা প্রত্যেকটি মানুষকে ধন্যবাদ।

শিক্ষামন্ত্রী, একজন গুরুজন হিসেবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তার জন্যে আমরা সবসময়ই তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।

প্রিয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, হাজার বছর এমনই অপ্রতিরোধ্য থাকো এবং ন্যায়ের সাথে থাকো। ভিকারুননিসার প্রতিটি শিক্ষার্থীই অসাধারণ। কেননা তারা অন্যায়ের ঊর্ধ্বে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, হোক সে জীবন দিয়ে কিংবা প্রতিবাদ করে।

 লেখকঃ ভিকারুননিসা নুন স্কুল এন্ড কলেজ, ১০ম শ্রেণি, মূল প্রভাতী

 ফরিদপুর প্রতিদিন
 ফরিদপুর প্রতিদিন
এই বিভাগের আরো খবর